আমরা জীবনধারণের জন্য যা খাই তাই খাদ্য। যে সব দ্রব্য ভক্ষণ করলে শরীরের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধি সাধন, তাপ উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় তাকেই খাদ্য বলে । খাদ্য গ্রহনের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো শরীরকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখা। শরীরের সুস্থতা নির্ভর করে দেহের পুষ্টি সাধন প্রক্রিয়ার উপর। মানুষের খাদ্য তালিকায় ফল একটি উল্লেখ যোগ্য স্থান দখল করে আছে। ফলে আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় প্রায় সকল পুষ্টি উপাদানই পাওয়া যায় । বিশেষত বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের সবচেয়ে সহজ ও সস্তা উৎস হলো ফল। ফল রান্না ছাড়া পাকা বা কাঁচা অবস্থায় সরাসরি খাওয়া যায়। ফলের পুষ্টি উপাদান সহজে শরীর গ্রহণ করতে পারে।
ফলের বিদ্যমান বিভিন্ন প্রকার খনিজ উপাদান যেমন-ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস ইত্যাদি শরীরে বিপাকে সহায়তা করে । এছাড়াও ফল শরীরের অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন- আমিষ, শর্করা, চর্বি, ভিটামিন, পানি ইত্যাদি সরবরাহ করে শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখে। ফল খাদ্য হিসাবে পুষ্টির অন্যতম বাহক ।
বিভিন্ন ফলের পুষ্টিমান
নিচের সারণিতে আমাদের দেশে প্রচলিত ও অপ্রচলিত বিভিন্ন ফলে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ উল্লেখ করা হলো।
সারণি: বিভিন্ন ফলের ভিটামিন ও খনিজ মানের পরিমাণ (প্রতি ১০০ গ্রাম )
শর্করা: দেহের শক্তির প্রধান উৎস হলো শর্করা । পুষ্টি বিধানে জরুরি উপাদান শর্করা সরবরাহে ফল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে । ফল দানাজাতীয় শর্করার পরিপূরক উৎস হিসেবে গণ্য হতে পারে । জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) এর মতে শরীরের চাহিদার শতকরা পাঁচভাগ ক্যালরি সবজি ও ফল থেকে আসা উচিত । কিসমিস, খেজুর, করমচা, কলা, বেল ইত্যাদি শর্করা প্রধান ফল ।
চবি: চর্বি জাতীয় খাদ্য দেহে সঞ্চিত শক্তি হিসেবে কাজ করে। মোট চাহিদার অন্তত দশভাগ খাদ্য শক্তি স্নেহজাতীয় খাদ্য হতে আসা উচিত । অন্যথায় স্নেহ দ্রবণীয় ভিটামিনসমূহ যেমন-ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে এর শোষণ বাধাপ্রাপ্ত হয় । কাজুবাদাম, এভােেকডো, করমচা, বাদাম, নারিকেল, কাঁঠাল বীজ, কদবেল ইত্যাদি ফল চর্বি সমৃদ্ধ ।
ভিটামিন: শারিরিক পুষ্টির জন্য ভিটামিনের অবদান অনস্বীকার্য। আর এ ভিটামিনের প্রধান উৎসই হলো শাকসবজি ও ফলমূল । মানবদেহের চাহিদার শতকরা প্রায় ৯০-৯৫ ভাগ ভিটামিন 'সি', ৬০-৮০ ভাগ ভিটামিন 'এ' এবং ২০-৩০ ভাগ ভিটামিন 'বি' সবজি ও ফল হতে আসে । বিভিন্ন ভিটামিন সরবরাহে ফলের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো
ভিটামিন 'এ': শরীরের পুষ্টি সাধনে এবং দৃষ্টিশক্তি অক্ষুন্ন রাখতে ভিটামি এর প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক । এর অভাবে রাতকানা রোগ হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় । হলুদ শাঁসবিশিষ্ট ফল যেমন: আম, পেঁপে, আমড়া, কাঁঠাল, ফুটি, বিলিম্বি, আলুচা, কমলা, বাতাবিলেবু, বেল, কাজুবাদাম, ডুমুর প্রভৃতি ফলে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন 'এ' বিদ্যমান রয়েছে ।
ভিটামিন বি ১ (Thiamine): শ্বেতসার বিপাক প্রক্রিয়া এবং স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কাজ নিয়ন্ত্রণে ভিটামিন বি ১ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে । এর অভাবে ক্ষুধা কমে যায়, বেরিবেরি রোগ দেখা দেয়, চর্মের অনুভব ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং পক্ষাঘাত দেখা দিতে পারে। কাজুবাদাম, আখরোট, বাদাম, খোবানী, কলা, লিচু, কমলা, আঙ্গুর, কিসমিস ইত্যাদি ফলে অধিক পরিমাণে ভিটামিন বি ১ রয়েছে ।
ভিটামিন বি ২ (Riboflavin): ভিটামিন বি ২ চর্মের মসৃণতা ও ক্ষুধা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে । এর অভাবে ক্ষুধা হ্রাস, গলায় ঘা, দেহের ওজন হ্রাস, নাক ফুলা ইত্যাদি শারিরীক জটিলতা দেখা দিতে পারে । বেল, কাজুবাদাম, পেঁপে, লিচু, আনারস, বেদানা, কদবেল প্রভৃতি ভিটামিন বি ২ এর ভাল উৎস।
ভিটামিন বি ৩ বা নায়াসিন (Niacine): এ ভিটামিন হজম শক্তি এবং চামড়ার মসৃণতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে ।
'ভিটাবিন সিঃ ভিটামিন 'সি' শরীরের বৃদ্ধি সাধন, রোগ প্রতিরোদ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং লৌহ ও ক্যালসিয়াম বিপাকে সাহায্য করে । এর অভাবে স্কার্ভি রোগ, দাঁতের মাড়ি ফুল ও দাঁত ক্ষয়, শরীরের জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা, হাত পা ফুলা, বাতব্যাধির লক্ষণ ইত্যাদি দেখা যায় । আমলকি, পেয়ারা, কমলা, লিচু, আনারস, স্ট্রবেরী, পেঁপে, সুপারি ইত্যাদি ফলে প্রচুর ভিটামিন সি বিদ্যমান।
খনিজ পদার্থ ও শরীরের সুষ্ঠু গড়নের জন্য খনিজ পদার্থ অপরিহার্য । বিভিন্ন ধরনের প্রধান খনিজ পদার্থগুলো হচ্ছে ক্যালসিয়াম, লৌহ, পটাসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, ফসরাস, সালফার, আয়োডিন ইত্যাদি । এদের মধ্যে কোন কোন গুলো শরীরে হাড়, রক্ত বা হরমোন তৈরির কাজে, খনিজ পদার্থ দেহের অম্ল- ক্ষারত্ব এবং বিভিন্ন অঙ্গে জলীয় অংশের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন এনজাইমের সুষ্ঠ কার্যাবলি সম্পাদনেও খনিজ পদার্থ সাহায্য করে । ক্যালসিয়ামের দিক হতে বাদাম, লিচু, করমচা, কদবেল, আখরোট, কিসমিস, আমলকি, বেল, কাজুবাদাম, খেজুর, ডুমুর, লেবু, কাগজীলেবু, কমলা প্রভৃতি ফসফরাসের দিক হতে বাদাম, কাজুবাদাম, কদবেল, এভোকেডো, কলা, বেল, সুপারি, খেজুর, ডুরিয়ান, করমচা, বেদানা, কিসমিস ইত্যাদি এবং লৌহের দিক হতে করমচা, খেজুর, কাজুবাদাম, আখরোট, কিসমিস, কাঁচা আম, বাদাম, স্ট্রবেরী, সুপারি, আপেল, আমলকি, ডুমুর, লিচু, পেয়ারা, শরীফা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
পানি সরবরাহে ফলের অবদান
শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পানি । পানি রক্তকে তরল রাখে, ভুক্ত খাদ্য দ্রব্য পরিপাকে সাহায্য করে এবং শরীরের দুষিত পদার্থ বের করে দিতে সহায়তা করে । বিভিন্ন ফল শরীরে পানির চাহিদা পূরণে সহায়তা করে । কচি নারিকেল (ডাব), আম, আনারস, পেঁপে, কমলা, কাঁঠাল, লিচু, লেবুজাতীয় ফল, পেয়ারা, তরমুজ, জামরুল ইত্যাদি ফলে প্রচুর পরিমানে পানি থাকে ।
অন্যান্য উপাদান
উপরোক্ত উপাদানসমূহ ছাড়াও এমন কিছু জৈব এসিড ও এনজাইম আছে যা আমাদের হজমে সহায়তা করে । যেমন: লেবু জাতীয় ফলে সাইট্রিক অ্যাসিড, আঙ্গুর ও তেওঁলে টারটারিক এসিড রয়েছে। এই সব জৈব অ্যাসিড ক্ষুধার উদ্দীপক ও হজমে সহায়তা করে । পেঁপে তে পেপাইন নামক হজমকারী এনজাইম রয়েছে । ফলে প্রচুর আঁশ থাকে যা পাকস্থলী ও অন্ত্রকে সর্বদা উত্তেজিত ও কর্মক্ষম রাখে এবং পাচনতনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে । ফলের আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। খাদ্য গ্রহণের মুখ্য উদ্দেশ্য কী ?
২। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের দৈনিক কত গ্রাম ফল খাওয়া উচিত ?
৩ । ফল খাদ্য হিসাবে পুষ্টির অন্যতম বাহক এ কথার অর্থ কী ?
৪। ফলের পুষ্টিগত গুরুত্ব বলতে কি বোঝায় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ফলের পুষ্টিগত গুরুত্ব বলতে কী বোঝায় ?
২। ভিটামিন 'এ' সমৃদ্ধ পাঁচটি ফলের বাংল ইংরেজি ও উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নাম লেখ ।
৩। আয়রন সমৃদ্ধ পাঁচটি ফলের বাংলা ইংরেজি ও উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নাম লেখ ।
৪ । ভিটামিন 'সি' সমৃদ্ধ পাঁচটি ফলের বাংলা, ইংরেজী ও উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নাম লেখ ।
৫। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পাঁচটি ফলের বাংলা ইংরেজি ও উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নাম লেখ ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। মানব দেহে পুষ্টি সরবরাহে ফল কীভাবে অবদান রাখে লেখ ।
২। বাংলাদেশে পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফল গুলোর গুরুত্ব বর্ণনা কর ।
৩। বিভিন্ন ফলে বিদ্যমান ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের পরিমাণ উল্লেখ করে তালিকা তৈরি কর।
Read more